চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের পাশে বসে আছে ১০ বছরের শিশু দেবরাজ। তার জীবন এখন যেন ঘোর অন্ধকারে। যে বয়সে কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে পড়াশোনার কথা, মা-বাবা বুকে পরম যত্নে থাকার কথা, সে বয়সে তার জীবন কাটছে কখনও আদালত ভবনে আবার কখনও হাসপাতালে। কারাবন্দি বাবার মুক্তির জন্য মন্দিরে মন্দিরে ছুটছে দেবরাজ।
জানা গেছে, ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী গলিতে জড়ো হতে থাকে যুবকের দল। ওসমান আলী নামে এক দোকানদারের ইসকনবিরোধী ফেসবুক পোস্টের জেরে ওই যুবকদের শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে হাজারী গলি। ব্যবসায়ী সমিতির প্যাডে নিজের দোষ স্বীকার করে লিখিতও দেয় মোল্লা স্টোরের মালিক ওসমান আলী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শান্তিপূর্ণ সতর্কতা অবস্থান ছিল। কিন্তু হঠাৎ পাল্টে যায় পুরো ঘটনা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাজারীগলি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কিছু অজ্ঞাত উচ্ছৃঙ্খল যুবক তাদের ওপর হামলা চালায়। এরপর শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান। পরদিন ৮০ জনকে আটকের কথা জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানার মামলার আসামি করা হয় ৪৯ জনকে। এরমধ্যে ৪৭ নম্বর আসামিতে নাম উঠে দেবরাজের বাবা মনা সরকারের। অন্য আসামিদের সঙ্গে মনার ঠাঁই হয়েছে চট্টগ্রাম কারাগারে। জামিন চেয়েও জামিন মেলেনি তার।
এদিকে মনার আটকের বিষয়টি জানতেন তার না ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী পূর্ণিমা ও ১০ বছরের একমাত্র সন্তান দেবরাজ। অনিয়মিত চিকিৎসার কারণে হাত-পায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে শরীর থেকে। ৫ নভেম্বর প্রেসক্রিপশন নিয়ে অসুস্থ স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে হাজারী গলি যান মনা সরকার। কিন্তু তাকে হামলার ঘটনায় আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। মনার আটক হওয়ার পর দু’দিন অনাহার-অর্ধাহারে ছিলেন পূর্ণিমা ও দেবরাজ। পরে বিষয়টি জানার পর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মহা মৃত্যুঞ্জয় ফাউন্ডেশন’র কর্মীরা এসে তাদের উদ্ধার করে এবং পূর্ণিমাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যায়।
শিশু দেবরাজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানায়, ‘আমার বাবা নির্দোষ। আমার মায়ের ওষুধ কিনতে হাজারী গলির ফার্মেসিতে গিয়েছিল বাবা। মায়ের জীবন বাঁচাতে বাবাকে ছেড়ে দিন।’
চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, বেডে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন পূর্ণিমা সরকার। কেমোর প্রভাবে চুল ঝরে গেছে। তার পাশেই বসে আছে ১০ বছরের ছেলে দেবরাজ। পূর্ণিমার কথা বলার শক্তি কেড়ে নিতে চাইছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। চর্মরোগে হাত-পায়ে পচন ধরায় জীবনটাই যেন বিষিয়ে উঠেছে তার।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের চিকিৎসকরা বলছেন, পূর্ণিমার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার হাতের যেসব স্থানে ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেসব স্থানে জরুরি সার্জারি প্রয়োজন।
অসুস্থ শরীর নিয়ে কথা বলেন পূর্ণিমা সরকার। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে দেবরাজকে দেখার কেউ নেই। আমাকে বাঁচাতে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। তবে টাকার অভাবে তাও নিয়মিত না। অনিয়মিত চিকিৎসার কারণে আমার হাত-পায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে শরীর থেকে। এর মধ্যে আমার স্বামী আমার জন্য ওষুধ আনতে গিয়ে এখন কারাবন্দি।’ এসব কথা বলতে বলতে ঢলে পড়ে যান পূর্ণিমা সরকার।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মহা মৃত্যুঞ্জয় ফাউন্ডেশন’র সদস্য শ্রুতি বলেন, ‘আমরা যখন খবরটি শুনি, তখন দুদিন পার হয়ে যায়। এ দুদিন মা-ছেলে অনাহারে ছিল। এরপর আমরা আসি। আমাদের একটি টিম রেডি করি। হাসপাতালে নিয়ে যায় পূর্ণিমাকে।’