চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ, তার পাঁচ ভাই, স্ত্রী এবং তাদের দুই সহযোগীসহ এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণাধীন ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি মামলা দায়ের করেছে রাষ্ট্রয়াত্ত জনতা ব্যাংক পিএলসি। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপি মামলা দেশে এবারই প্রথম।
রোববার (১ ডিসেম্বর) বিকালে চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতের জজ মুজাহিদুল রহমানের আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম।
রেজাউল করিম বলেন, অর্থঋণ আদালতে জনতা ব্যাং ক এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার মামলা দায়ের করেছেন। জনতা ব্যাংক চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ চৌমুহনী জীবন বীমা শাখা এ মামলাটি দায়ের করেছেন।
মামলার আসামিরা হলেন—গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুছ সবুর, ব্যাবস্হাপনা পরিচালক এস আলমের ছোট ভাই রাশেদুল আলম, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্হাপনা পরিচালক সাইফুল আলম মাসুদ, তার ছোট ভাই আবদুল্লাহ হাসান, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের পরিচালক আবদুস সামাদ লাবু, ওসমান গনী, লাবুর স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের পরিচালক মিশকাত আহমদ, এস আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভিন, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আলম।
এছাড়াও এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণাধীন আরও ১৩ শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও এ মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো—এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, এস আলম কোল্ডরোল স্টিলস লিমিটেড, এ আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড, এস আলম স্টিল লিমিটেড, এস আলম সিমেন্ট লিমিটেড, এস আলম ব্রাদার্স লিমিটেড, এস আলম সয়া সীড লিমিটেড, এস আলম ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মিলস লিমিটেড, এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড, এস আলম লাক্সারী চেয়ারকোচ সার্ভিস লিমিটেড ও চেমন ইস্পাত লিমিটেড।
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর ২০২১ সালের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা না মেনে ঋণসীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে। ২০১২ সালে সাধারণ বীমা ভবনে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম করপোরেট শাখা থেকে প্রাথমিকভাবে ৬৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয় গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন। এ ঋণ ২০২১ সাল পর্যন্ত সুদ-আসলে মোট ১ হাজার ৭০ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৬১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা পিএডি (পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট), ২২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা এলটিআর (লোন ট্রাস্ট রিসিপ্ট) ঋণ এবং ২২৯ কোটি ৯৯ কোটি টাকা সিসি হাইপো ঋণ। সুদ-আসল মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে জানা গেছে, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন শিল্প কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য এবং নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসায় জড়িত ছিল।
এর আগে গত ২০ নভেম্বর জনতা ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে এস আলম গ্রুপের ১ হাজার ৮৬০ শতাংশ জমি নিলামে তোলে। জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা ভবন কর্পোরেট শাখা থেকে এই ঋণ নেওয়ার ফলে শাখাটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিলাম ডাকে। আপাতত গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশনের ঋণ আদায়ে নিলাম ডাকা হলেও ধীরে ধীরে অন্য ঋণের জন্য অন্য বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে বলে জানা গেছে। নিলামে তোলা সম্পদগুলো চট্টগ্রামের পটিয়া, কর্ণফুলী, কোতোয়ালী, চান্দগাঁও ও বাকলিয়া উপজেলায় এবং গাজীপুরে। এসব জমির বাজারমূল্য সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার মতো।
২০০৪ সাল থেকে এসআলম গ্রুপ জনতা ব্যাংকের গ্রাহক। ব্যাংকটির চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখার দেওয়া ঋণের ৮০ শতাংশের বেশি নিয়েছে গ্রুপটি। এই শাখায় এসআলম গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই খেলাপি। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটিতে বন্ধক রয়েছে ২ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকার জমি ও স্থাপনা।
আদালতের আদেশ সূত্রে জানা গেছে, ঋণ নেওয়ার পর আদায় না করার কারণে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ তার পাঁচ ভাইসহ ২৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে সাইফুল আলমের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে থাকা শেয়ার ক্রোক অবস্থায় রাখার নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনকে উক্ত ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল অনিয়মের তদন্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।